শেষের_পঙক্তি
লেখনীতেঃ নুরুন্নাহার_তিথী
পর্ব_৫
মিহালকে রিজভী কাঁধে ঝাঁকি দিয়ে বলে,
–দোস্ত, চল এবার। রেস্টুরেন্টে যাবো খুব খিদে পেয়েছে। সামনেই একটা ভালো রেস্টুরেন্ট আছে। চল সেটাতে যাই।
মিহাল দীর্ঘশ্বাস ফেলে রাজি হয়ে যায়। তারপর ওরা সেই রেস্টুরেন্টের উদ্দেশ্যে রওনা হয় কিন্তু পথিমধ্যে একটা কফিশপের বাহিরে মিহাল কাউকে দেখে থমকে দাঁড়ায়। মিহাল দেখে অতি পরিচিত হাস্যজ্জল রমণী কোন এক অচেনা পুরুষের সাথে হেসে হেসে কথা বলছে। দেখে মনে হচ্ছে যেন ওরা দুইজনে কফিশপ থেকে বের হয়েছে মাত্র। তবে কি ওরা দুইজন কফিশপে দেখা করতে এসেছিল? কিছুক্ষণ আগের রাগের স্ফুলিঙ্গ এখন আরো ধপধপ করে উঠলো। মিহাল রাগে হনহনিয়ে রেস্টুরেন্টের ভিতর ঢুকে গেলো। রেস্টুরেন্টের দরজাটা একটু জোরে খোলার কারণে তাইজুল ও রিজভী দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে। অতঃপর ডান পাশে চোখ যেতে দেখে তূর ওদের দিকে এগিয়ে আসছে। রেস্টুরেন্টের পাশেই কফিশপ না। একটা দুইটা দোকান ব্যাবধান। মিহাল তখন তূরকেই দেখেছিল কারো সাথে হেসে কথা বলতে। মিহাল তূরকে পরিচিত বন্ধুদের ছাড়া কারো সাথে দেখলে সহ্য করতে পারে না। আর যেই ছেলেটার সাথে তূর কথা বলছিল সেই ছেলেটার হাতে এপ্রোন ও স্টেথোস্কোপ ছিল।
তূর রিজভী ও তাইজুলের কাছে এসে হাসি মুখে বলে,
–কি ব্যাপার? তোমারা এখানে?
মিহাল ওদিকে রেস্টুরেন্টের ভিতরে রাস্তার সাইডে বসেছে। হাফ থাই গ্লাস দেয়াতে বাহিরের দৃশ্য দেখা যায়। তূরকে সে রিজভী ও তাইজুলের সাথে কথা বলতে দেখছে কিন্তু শুনতে পাচ্ছে না। তূরের ঠোঁট এলিয়ে লাস্যময়ী হাসি যেন মনমুগ্ধকর। হাসিতে যার চোখ হাসে সাথে ঠোঁটের কোনে টোল পরে। না হোক সে গৌরবর্ণের অধিকারী! খানিকটা শ্যামলতা হলে ক্ষতি কি! তার উজ্জ্বল গায়ের রং সূর্যের আলোয় যেন ঝলমল করে। লতানো চুলগুলো উড়ে মুখের উপর পরার পর সেটা সরানোও একটা মুগ্ধতার শিল্প যেনো।
তূরের করা প্রশ্নে তাইজুল জবাব দেয়,
–শপিং করলাম। ট্যুরে যাবো তো দেখলাম ভালো কোনো স্নিকার্স ও ড্রেস নেই।
তূর মুখ বাঁকিয়ে বলে,
–আসলেই তোমাদের স্নিকার্স নেই! অবশ্য স্নিকার্স প্রেমিদের যতোই থাকুক তাও ওদের নাকি নেই!
রিজভী হেসে বলে,
–এটা তুমি ঠিকই বলেছো। আমি আবার স্নিকার্স নেই নি। তিনটার মতো তো বাসায় পরেই আছে। ওগুলোই ব্যাবহার করবো। তা তুমি এখানে?
তূর হেসে জবাব দেয়,
–একজনের সাথে দেখা করতে এসেছিলাম।
রিজভী বলে,
–ওহ আচ্ছা। আসো একসাথে লাঞ্চ করি। ১২ টা তো বাজে।
তূর ভদ্রতা রেখে বলে,
–আসলে বাসায় গোছগাছ করতে হবে। কালকেই তো দেশে আসলাম আবার আজকে রাতে ট্যুরে যাবো। একটু প্রিপারেশন নিতে হবে। আর একটা লং জার্নির পর আরেকটা লং জার্নি। শরীর ধকল নিতে পারবে কিনা কে জানে! তোমাদের জবের জয়েনিং এর জন্যই আজকে যেতে হচ্ছে। নাহলে কিছুদিন পর যেতাম। তাহলে আসি। টাটা।
রিজভী ও তাইজুল বুঝে তারপর তূরকে বিদায় দিয়ে রেস্টুরেন্টের ভিতর ঢুকে। মিহালের সাথে এসে বসার পর ওরা দেখে মিহাল কাঁটাচামচ ঘুরাচ্ছে। ওয়েটার এসে অর্ডার নিয়ে গেলো। এখনও যেহেতু পুরোপুরি লাঞ্চ টাইম হয়নি তাই ওরা বেকড পাস্তা অর্ডার করলো। একটা থেকেই তিনজন খাবে। পাস্তার কোয়ান্টিটিও বেশি। অর্ডার আসার আগ পর্যন্ত মিহাল কাঁটাচামচ হাত থেকে সরালো না। রিজভী ব্যাপারটা না বুঝে জিজ্ঞাসা করে,
–তখন ওভাবে চলে এলি কেনো? জানিস তূরের সাথে দেখা হয়েছিল।
মিহাল কাঁটাচামচ দেখতে দেখতে বললো,
–ওহ!
রিজভীর কাছে আজব লাগলো। তারপরেও দুঃখ করে বললো,
–বেচারির জন্য টাফ হবে অনেক জার্নিটা। একটা জার্নির ধকল না কাটতেই আরেকটা জার্নি।
মিহাল হুট করে ভাবলেশহীন ভাবে বলে ফেলে,
–তাহলে সে না যাক! এতো কস্ট করে যাওয়ার দরকার কি? গুরুত্বপূর্ণ কারো সাথে দেখা করার সময় তো তার ক্লান্তি থাকে না। তাই না!
রিজভী ও তাইজুল দুইজনেই বে*কুবের মতো নিজেদের দেখছে। মিহাল কি মিন করছে তা ঠিকভাবে তাদের বোধগম্য হচ্ছে না। তাইজুল জিজ্ঞাসা করে,
–কি বলতেছিস তুই? তোর কথার মানে বুঝতেছি না আমরা।
মিহাল এবার কাঁটাচামচটা টেবিলের উপর সজোরে রেখে সিটের সাথে হেলান দিয়ে বুকের উপর দুইহাত আড়াআড়িভাবে রেখে ভাবলেশহীনভাবে বলে,
–ওই ছেলেটা কিন্তু গুড লুকিং এন্ড স্মার্ট ছিল। ওর পছন্দ খুব পারফেক্ট!
এবারও দুই বে*কুবের মাথার উপর দিয়ে গেলো। দুজনের ঠোঁটে সেন্টি মার্কা হাসি। মিহাল সেসব তোয়াক্কা না করে আবার বলে,
–এইজন্যই কালকে তার ব্যাবহার কেমন চেঞ্জড লাগছিল। আমার উপস্থিতি তাকে বিরক্ত করছিল। যেন আমি তার কাছে ম্যাটার করি না। হাউ ফানি না! নতুন কেউ তার জীবনে এসে গেছে। তারউপর সেই নতুন কেউ স্মার্ট এন্ড প্রফেশনটাও স্মার্ট। তূরের পছন্দের প্রফেশন বলে কথা।
রিজভী অবাক হয়ে তাইজুলের দিকে একবার তাকায়। তাইজুলও একই ভাবে তাকায়। তারপর রিজভী বোকার মতো প্রশ্ন করে,
–তূরের কথা বলছিস? তূর কাকে ভালোবাসে? কার সাথে রিলেশনে আছে?
মিহাল বিরক্তই হলো। সে বললো,
–যাকে সে ভালোবাসে!
রিজভী ও তাইজুল বে’ক্কল বনে গেলো। বেকড পাস্তা এসে গেছে। ওরা তিনজনেই একটু একটু করে খাচ্ছে। এরপর দুপুরের লাঞ্চ করে ওরা যার যার বাড়িতে রওনা হলো।
_________
বাড়ি ফিরে তূর বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। টায়ার্ড লাগছে তার। ভাবছে দুপুরের খাবার খেয়ে দুপুর ৩ টা থেকে ৫.৩০ টা পর্যন্ত ঘুমাবে। মাগরিবের সময় তো ৬.১০ এ। এখন বাজে দুপুর ২টা। নীরা তাড়াহুড়ো করে তূরের রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয় তারপর তূরের পাশে এসে বসে। তূর নীরার দিকে চোখ ছোট ছোট করে তাকায়। দরজা তাড়াহুড়ো করে লাগাতে যাওয়ার দরুন কিছুটা শব্দের সৃষ্টি হয়েছে। নীরা মনের মধ্যে উত্তেজনা নিয়ে তূরকে জিজ্ঞাসা করে,
–ডাক্তার ইফতিকে তোর কেমন মনে হলো? ইজ হি রাইট ফর মি?
তূর শোয়া থেকে উঠে বসতে বসতে বলে,
–হুম খারাপ না। কথার ধরন ও ব্যবহার খুবই ভালো, প্রশংসনীয়। অহংকার লক্ষ্যনীয় ছিল না। প্রথমে তার চেম্বারে গিয়েছি তারপর চেম্বারে গিয়ে তাকে তোর পরিচয় দিয়ে বলেছি যদি একটু কফিশপে আসে। সে হাতে থাকা কয়েকটা রোগী দেখে আমার সাথে গেলো। তারপর তোর কথা ও কখনো আর কাউকে ভালো লেগেছিল কিনা তা জিজ্ঞাসা করেছি। আরও টুকটাক পরিচয় ও স্টাডি নিয়ে কথা হলো। সে সবকিছুর সুন্দর করে জবাব দিয়েছে। আমার তার কথা বলার ধরনে মিথ্যা মনে হয় নি।
নীরা উৎসুক হয়ে জিজ্ঞাসা করে,
–তার কি কখনো আগে কারো সাথে রিলেশন ছিল?
তূর আফসোস করে বলে,
–ছিল!
নীরার চোখ-মুখ কেমন যেনো হয়ে গেলো। তূর আবারো বলে,
–কিন্তু সেই মেয়েটা আর এই ইহজগতে নেই। ১০ বছর আগে কানাডাতে কার এক্সিডেন্টে মেয়েটা মা*রা যায়। তখন ডাক্তার ইফতি ১৯ বছরের আর মেয়েটা ১৬ বছরের ছিল। মেয়েটা ছিল ডাক্তার ইফতির ফুফির মেয়ে। ডাক্তার ইফতির যখন দুই বছর তখন তার বাবা-মা, ফুফিরা কানাডা চলে গিয়েছিলেন। তার বাবার কানাডাতে বিজনেস ব্রাঞ্চ আছে আর তার ফুফারও তাতে ৫০% শেয়ার। ডাক্তার ইফতির অতীতের ভালোবাসার মানুষটার নাম ছিল নীরা! হ্যাঁ। ওই মেয়েটার নামও তোর নামের সাথে মিল ছিল।
নীরা অবাক হয়। ওই মেয়েটার মৃত্যুর খবরে দুঃখ পেলেও কিছু একটা ভেবে নীরার হৃদয় ব্যাথিত হলো। নীরা কম্পমান স্বরে বললো,
–নামের মিলের কারণে কি সে আমার বিয়ে করতে চায়?
তূর অবাক হলো না নীরার প্রশ্নে। এরকম প্রশ্নই তূর আশা করছিল।
চলবে ইন শা আল্লাহ,
ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন ও কার্টেসি ছাড়া কপি নিষিদ্ধ।